সারাবিশ্বে ৪১৫ মিলিয়ন লোক ডায়াবেটিস বা বহুমূত্র রোগে আক্রান্ত। ২০৪০ সালে ৬৪০ মিলিয়নে ছাড়িয়ে যাবে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।
ডায়াবেটিসের সমপরিমাণ লোক প্রাক-ডায়াবেটিসে ভুগছে। বিশ্বে ১০ জনের মধ্যে একজন নারী এবং প্রতি সাতজনে একজন গর্ভবতী নারী ডায়াবেটিসে আক্রান্ত। বাংলাদেশের মতো স্বল্প ও মধ্যম আয়ের দেশগুলোতে এর প্রবণতা বেশি। অথচ সুশৃঙ্খল জীবনাচরণের মাধ্যমে ৫০ ভাগ লোকের ডায়াবেটিস প্রতিরোধ করা যায়।
ডায়াবেটিস কী? (What is Diabetes)
আমাদের প্রধান খাদ্য উপাদান হলো শর্করা। এই শর্করা ভেঙে হয় গ্লুকোজ। আবার আমিষ বা চর্বিজাতীয় খাবার ভেঙেও বিশেষ অবস্থায় গ্লুকোজে পরিণত হয়। গ্লুকোজ শরীরের প্রধান জ্বালানি। এসব গ্লুকোজের মাত্রা নিয়ন্ত্রণে রাখে যে হরমোন তার নাম ইনসুলিন।
ইনসুলিন আসে অগ্ন্যাশয় (প্যানক্রিয়াস) থেকে। এটি রক্ত থেকে গ্লুকোজকে কোষে সরিয়ে নেয়।
কিন্তু যদি কোনো কারণে অগ্ন্যাশয়ে পর্যাপ্ত পরিমাণে ইনসুলিন তৈরি না হয় অথবা শরীরের কোষগুলো ইনসুলিনের প্রতি যথেষ্ট সাড়া না দেয় তাহলে রক্তে গ্লুকোজের এই মাত্রা বাড়তে থাকে। এ অবস্থাকেই
আমরা বলি ডায়াবেটিস, যাকে বাংলায় বলে বহুমূত্র রোগ।
কারণ ও প্রকারভেদ (Reasons and Types):
প্রধানত দুটি কারণে এ রকম অবস্থার সৃষ্টি হতে পারে।
টাইপ-১ (Type 1) : শরীরে অগ্ন্যাশয় গ্রন্থিতে ইনসুলিন হরমোন নিঃসরণকারী বিটা সেলের পরিমাণ ব্যাপক হারে হ্রাস পাওয়া এবং বিটা সেল থেকে নিঃসৃত ইনসুলিন যদি কোষের ওপর সঠিকভাবে কাজ করতে না পারে। এ ক্ষেত্রে অগ্ন্যাশয় গ্রন্থিতে বিটা সেলের পরিমাণ শূন্যের কোঠায় পৌঁছলে তখন ইনসুলিন বাইরে থেকে নেওয়া (ইনজেকশনের মাধ্যমে) ছাড়া কোনো উপায় থাকে না। এ ধরনের ডায়াবেটিসকে টাইপ-১ বা ইনসুলিননির্ভর ডায়াবেটিস বলে।
টাইপ-২ (Type 2) : শরীর যখন ইনসুলিন তৈরি করতে পারে, অর্থাৎ সামান্য পরিমাণ বিটা সেল উপস্থিত থাকে, কিন্তু শর্করার বিপাকের জন্য তা পর্যাপ্ত নয়, এ ধরনের ডায়াবেটিসকে টাইপ-২ ডায়াবেটিস বলে। টাইপ-২ ডায়াবেটিসের সঙ্গে স্থূলতার একটি ভালো সম্পর্ক রয়েছে। শিশুদেরও এ রোগ হতে পারে। তবে চল্লিশোর্ধদের মধ্যে এই রোগের প্রবণতা বেশি (৯০ শতাংশ)।
আরেক ধরনের ডায়াবেটিস রয়েছে, যাকে বলে গেস্টেশনাল ডায়াবেটিস বা গর্ভকালীন ডায়াবেটিস। যখন কোনো মায়ের গর্ভাবস্থায় প্রথমবারের মতো ডায়াবেটিস ধরা পড়ে তখন তাকে গর্ভকালীন ডায়াবেটিস বলে। এ ক্ষেত্রে ২৫ থেকে ৫০ শতাংশ রোগী পরবর্তী সময় স্থায়ীভাবে টাইপ-২ ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হয়। বাংলাদেশে এর প্রবণতা অনেক বেশি।
আরেক ধরনের ডায়াবেটিস রয়েছে, যাকে বলে গেস্টেশনাল ডায়াবেটিস বা গর্ভকালীন ডায়াবেটিস। যখন কোনো মায়ের গর্ভাবস্থায় প্রথমবারের মতো ডায়াবেটিস ধরা পড়ে তখন তাকে গর্ভকালীন ডায়াবেটিস বলে। এ ক্ষেত্রে ২৫ থেকে ৫০ শতাংশ রোগী পরবর্তী সময় স্থায়ীভাবে টাইপ-২ ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হয়। বাংলাদেশে এর প্রবণতা অনেক বেশি।
লক্ষণ (Symptoms)
বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই শুরুতে রোগীরা বুঝতেই পারে না যে তাদের ডায়াবেটিস হয়েছে। কারো কারো ক্ষেত্রে ঘন ঘন পিপাসা লাগা, দুর্বল লাগা, ঠোঁট ও মুখ শুকিয়ে যাওয়া, ঘন ঘন ক্ষুধা লাগা, শরীর শুকিয়ে যাওয়া—এসব লক্ষণ দেখা যায়। কেউ কেউ ডাক্তারের কাছে আসেন পায়ে, নখে, চামড়ায় বা যৌনাঙ্গে বিভিন্ন রকম ইনফেকশন নিয়ে।
ডায়াবেটিস হলে মেজাজ বিগড়ে যেতে পারে, মুড ওঠানামা করে। হাত-পা জ্বালাপোড়া করাও ডায়াবেটিসের লক্ষণ। তবে ডায়াবেটিসে আক্রান্ত অথচ উপসর্গহীনতা বা অসচেতনতার কারণে ৫০ শতাংশ রোগীই জানেন না যে তাদের ডায়াবেটিস আছে। বিশেষ করে টাইপ-২ ডায়াবেটিস রোগীদের এ সমস্যা বেশি।
পরীক্ষা (Test)
ডায়াবেটিস রোগী ছাড়াও যাদের নিকটাত্মীয়ের ডায়াবেটিস আছে, যাদের ওজন বেশি, ব্যায়াম বা শারীরিক পরিশ্রমের কাজ তেমন করেন না, তাঁরা নিচের পরীক্ষাগুলোর মাধ্যমে ডায়াবেটিস সম্পর্কে জানতে পারেন।
খালি পেটে বা খাবারের আগে (Fasting Blood Glucose) : এ পরীক্ষাটি সকালে নাশতার আগে খালি পেটে করতে হয়। এর স্বাভাবিক মাত্রা ৬.১ মিলিমল বা লিটার বা তার কম।
খাবারের দুই ঘণ্টা পরে (2 Hour After Breakfast) : এ পরীক্ষাটি নাশতা খাওয়ার দুই ঘণ্টা পরে করতে হয়। এর স্বাভাবিক মাত্রা ৭.৮ মিলিমল বা লিটার বা তার কম।
যেকোনো সময় (Random) : এ পরীক্ষাটি দিনের যেকোনো সময় করা যেতে পারে। এর স্বাভাবিক মাত্রা ৭.৮ মিলিমলের কম।
Oral Glucose Tolerance Test (OGTT) : এ পরীক্ষাটির জন্য রোগীকে প্রথমে খালি পেটে রক্ত দিতে হবে। এরপর ৭৫ গ্রাম গ্লুকোজ পানিতে মিশিয়ে খেতে হবে এবং ঠিক দুই ঘণ্টা পর রোগীকে আবার রক্ত দিতে হবে। এই দুই ঘণ্টা রোগী অন্য কোনো খাবার খেতে পারবে না। কোনো ধরনের শারীরিক পরিশ্রমের কাজ, এমনকি ধূমপানও করা যাবে না। এ পরীক্ষায় যে রোগীর খালি পেটে ৭.০ মিলিমল বা লিটারের চেয়ে বেশি এবং দুই ঘণ্টা পর ১১.১ মিলিমল বা লিটারের চেয়ে বেশি হবে, তাকে নিশ্চিত ডায়াবেটিস রোগী হিসেবে চিহ্নিত করা যাবে।
গ্লাইকোলাইলেটেড হিমোগ্লোবিন : এ পরীক্ষার মাধ্যমে রক্তে গত চার মাসের গ্লুকোজের মাত্রার একটা ধারণা পাওয়া যাবে। এ পরীক্ষাটি খালি পেটে অথবা খাওয়ার পর যেকোনো অবস্থায় করা যায়। এর স্বাভাবিক মাত্রা ৭ ভাগের নিচে থাকলে সুগার কন্ট্রোলে আছে বোঝা যায়।
ঝুঁকি (Risks)
সব রোগের জন্মদাত্রী বলা হয় ডায়াবেটিসকে। শরীরে এমন কোনো অঙ্গ নেই যেখানে ডায়াবেটিস তার ক্ষতিকর প্রভাব বিস্তার করে না। উন্নত বিশ্বের বেশির ভাগ দেশে ডায়াবেটিসকে মৃত্যুর চতুর্থ প্রধান কারণ হিসেবে ধরা হয়। ডায়াবেটিসে সাধারণত যেসব সমস্যা হতে পারে তা হলো :
♦ কিডনির অক্ষমতা বা কিডনি বৈকল্য।
♦ বিশ্বে প্রতি ৩০ সেকেন্ডে একটি করে পা কাটা যাচ্ছে ডায়াবেটিসজনিত কারণে। আবার যত পা কেটে ফেলতে হচ্ছে, এর ৮৫ শতাংশের প্রধান কারণ রোগীদের অসচেতনতা।
♦ স্ট্রোকের ঝুঁকি বাড়ে। চোখে রেটিনোপ্যাথি হয়ে চোখে কম দেখা, ঝাপসা দেখা, চোখের ছানিপড়া ইত্যাদি সমস্যা হতে পারে। অন্ধত্ব ও দৃষ্টিবিচ্যুতির নানা কারণ ডায়াবেটিস।
♦ হৃদরোগের ঝুঁকি ও হার্ট অ্যাটাকে মৃত্যুর আশঙ্কা বাড়ে।
♦ শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যায়। ফলে শরীরে বাসা বাঁধে নানা রকম ইনফেকশন। আবার পেরিফেরাল নিউরোপ্যাথি হলে হাত-পা জ্বালাপোড়া করাসহ বোধশক্তি কমে যায়। শরীরের মাংসপেশিগুলো দুর্বল হয়ে যায়।
ডায়াবেটিস প্রতিরোধযোগ্য |
প্রতিরোধে করণীয় (What to do to Prevent)
পরিমিত খাদ্য, নিয়মিত ওষুধ ও সুশৃঙ্খল জীবন—এই তিনটি নীতি ডায়াবেটিসের রোগীরা সঠিকভাবে পালন করলে সুস্থ-স্বাভাবিক জীবনযাপন করতে পারবেন। সচেতনতা ও সুশৃঙ্খল জীবনাচরণই ডায়াবেটিসের প্রধান চিকিৎসা।
গবেষণায় দেখা গেছে, ৫০ থেকে ৭০ ভাগ ক্ষেত্রে টাইপ-২ ডায়াবেটিস প্রতিরোধ করা সম্ভব।
♦ প্রথমেই খাবারদাবারে নিয়ম মেনে চলতে হবে। পরিমিত সুষম খাবার গ্রহণ করতে হবে। চিনি, মিষ্টিযুক্ত খাবার (সফট ড্রিঙ্কস, চকোলেট, কেক, পেস্ট্রি, কুকি ইত্যাদি) বাদ দিতে হবে। শাকসবজি ও আঁশজাতীয় খাবার খেতে হবে।
♦ ক্যালরিবহুল খাবার, যেমন তেল-চর্বিযুক্ত খাবার (তেল, ঘি, মাখন, ডালডা, চর্বি, ডিমের কুসুম, মগজ ইত্যাদি) কম খেতে হবে। ফাস্টফুড এড়িয়ে চললে ভালো। শর্করাবহুল খাবারগুলো (চাল, আটা ইত্যাদি দিয়ে তৈরি খাবার) কিছুটা হিসাব করে খেতে হবে। শাকসবজি, ফলমূল বেশি করে খেতে হবে। দৈনিক ক্যালরি হিসাব করে খাবার খেতে হবে। প্রয়োজনে পুষ্টিবিদের পরামর্শ নিতে হবে।
♦ ফাস্ট ফুড ও কোল্ড ড্রিংকস পরিহার করে প্রতিদিন পর্যাপ্ত বিশুদ্ধ পানি পান করা উচিত। এ ছাড়া বিভিন্ন অনুষ্ঠানে পরিবেশিত রিচ ফুড যথাসম্ভব পরিহার করা শ্রেয়।
♦ ধূমপানসহ সব ধরনের তামাক বর্জন করতে হবে। অ্যালকোহল মোটেই নয়।
♦ প্রতিদিন কমপক্ষে ৩০ মিনিট করে সপ্তাহে ১৫০ মিনিট দ্রুত পায়ে হাঁটুন। সাইকেল চালান, সাঁতার কাটুন কিংবা সিঁড়ি ভাঙুন। মনে রাখবেন, রক্তের গ্লুকোজগুলো পোড়াতে হবে কাজের মাধ্যমেই।
♦ বিশেষজ্ঞের পরামর্শ অনুযায়ী উপযুক্ত ব্যায়াম নির্বাচন করুন। কারণ সব ব্যায়াম সবার জন্য উপযুক্ত নয়। আবার ব্যায়াম করছেন এ ধারণা মাথায় রেখে অতিরিক্ত খাদ্য গ্রহণ করবেন না।
♦ একটানা বেশি সময় বসে কাজ করবেন না। কাজের ফাঁকে উঠে দাঁড়ান। একটু পায়চারী করুন।
♦ উচ্চতা অনুযায়ী ওজন স্বাভাবিক মাত্রায় রাখার চেষ্টা করতে হবে। মেদভুঁড়ি যেন না বাড়ে, সেদিকে খেয়াল রাখুন।
♦ বিষণ্নতা ডায়াবেটিস বাড়ায়, তাই মনকে প্রফুল্ল বা মানসিক চাপমুক্ত রাখার চেষ্টা করুন।
♦ খাওয়ার ওষুধ বা ইনসুলিন যাই হোক চিকিৎসা নিয়মিত চালাবেন। রক্তের গ্লুকোজ নিয়ন্ত্রণে থাকলে শরীরের সব অঙ্গই ঠিক থাকবে।
♦ শিশু-কিশোরদের মধ্যে আজকাল টাইপ-২ ডায়াবেটিস বেড়ে যাচ্ছে। তাই তারা যেন অপুষ্টিতে না ভোগে আবার অতিপুষ্টিতে ওজন না বাড়ে, সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। একই সঙ্গে শিশুরা যেন শ্রমবিমুখ না হয়, তা দেখাও গুরুত্বপূর্ণ।
♦ গর্ভকালীন মায়ের পুষ্টি নিশ্চিত করতে হবে যেন গর্ভস্থ শিশু অপুষ্টিতে না ভোগে।
♦ একান্তই ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হয়ে থাকলে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শমতো চিকিৎসা গ্রহণ করুন। ওষুধ, ব্যায়াম, খাদ্যগ্রহণ তথা সার্বিক জীবনযাপনসংক্রান্ত সুনির্দিষ্ট ও বিজ্ঞানসম্মত নির্দেশনা মেনে চলুন। কেননা কারো ডায়াবেটিস হলে তিনি যদি সঠিক নিয়ম মেনে চলেন তবে স্বাভাবিক জীবনযাপন করতে পারবেন।
লিখেছেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের এন্ডোক্রাইনোলজি বিভাগের প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান ও কোর্স কো-অর্ডিনেটর অধ্যাপক ডা. ফরিদ উদ্দিন
0 comments:
Post a Comment